চব্বিশের ভোটে উধাও ‘কিম্ভূত কিমাকার’ থেকে ‘দিদি ও দিদি’ টিটকিরি, বঙ্গে বদল রাজনীতির সমীকরণ?

রাজনীতিবিদদের এই মানোন্নয়ন কি স্বেচ্ছায়? নাকি এর পিছনেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে?

চব্বিশের ভোটে উধাও ‘কিম্ভূত কিমাকার’ থেকে ‘দিদি ও দিদি’ টিটকিরি, বঙ্গে বদল রাজনীতির সমীকরণ?

ভারতীয় রাজনীতি অনেক আগেই নৈতিকতার রেখা অতিক্রম করেছে। 2021 সালের বাংলা বিধানসভা নির্বাচনে শালীনতার স্তর বজায় রাখা যায়নি। অতীতের সমস্ত নজির ব্যক্তিগত আক্রমণ, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার এবং গালি দিয়ে উল্টে গেছে বলে মনে হচ্ছে।সেদিক থেকে 24 তম লোকসভা নির্বাচন একটি স্বর্ণরেখার মতো। এই প্রচারণা নৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে, তবে শালীনতা বজায় রাখার কিছু চেষ্টা করা হয়েছে। অন্তত বাংলার নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যক্তিগত আক্রমণ একুশের পর্যায়ে পড়েনি। এটা কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে হতে পারে।

একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার রাজনীতির মান অন্য স্তরে নেমে যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে যেভাবে একাধিক বৈঠকে এসে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দিদি ও দিদি’ বলে কটূক্তি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভাগ্নেকে ‘তোলাবাজ ভাইপো’ বলে যেভাবে বারবার আক্রমণ করেছেন, তা অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ছিল না। প্রধানমন্ত্রী, আবার বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে ‘মুখ্যমন্ত্রীর বারমুডা পরা’ বা ‘তাঁকে ঘষা’র মতো নিন্দা করতে শোনা গেছে। ‘তোমাকে দাফন করব’, ‘লাশের গায়ে লাইন দেব’-এর মতো হুমকিও দেওয়া হয়েছে মাস্তানির সুরে। শুভেন্দু অধিকারী আবার মুখ্যমন্ত্রীকে সম্বোধন করতে ‘মমতাজ বেগম’, ‘জেহাদি’-এর মতো শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে আক্রমণের মাত্রাও ছিল একই রকম। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির শীর্ষ নেতাদের কখনও কিমভুত কিমাকার, কখনও হোন্ডল কুটকুট বলে কটাক্ষ করেছেন। সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়।আসলে একুশের নির্বাচনে প্রতিযোগিতার তীব্রতা ছিল খুব বেশি। একইভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাত্রাও কমেছে। সে তুলনায় চব্বিশ-এর প্রচারণা আরও পরিণত, আরও সাবলীল এবং আরও শালীন। প্রধানমন্ত্রী 24 তম লোকসভায় বাংলায় 20-25টি নির্বাচনী কর্মসূচি করেছেন।এমনকি একবারও ‘দিদি ও দিদি’-এর মতো শ্লেষ তাঁর মুখে শোনা যায়নি। এই প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেও সরাসরি কিছু বলেননি তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এছাড়াও সন্দেশখালি, সিএএ, অনুপ্রবেশের মতো বিষয়গুলি ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের চেষ্টা করা হয়েছে।কিন্তু কোনোভাবেই ওই ব্যক্তি মমতাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেননি। অমিত শাহ, জেপি নাড্ডার ক্ষেত্রেও একই কথা। এমনকী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও এ বার এমন ব্যক্তিগত আক্রমণ শোনা যায়নি। সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী। কোথাও তুমি-আদেশের মহিমা ভুলে গিয়ে টোকারিতে নেমেছ। কিন্তু এটা কোনোভাবেই একুশের নির্বাচনের মতো ‘কিমবুত কিমাকা’ হামলা নয়।

এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের রাজনীতিবিদদের এই উন্নতি কি স্বেচ্ছায়? নাকি এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে? ওয়াকিবহাল সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয়টি আরও সত্য। কারণ, বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ আক্রমণ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি, তা 2018 সালের নির্বাচনে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বুঝতে পেরেছেন।কোনো নারী মুখ্যমন্ত্রী বা কোনো নারীকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য বা টোন টুইট কখনোই বরদাস্ত করবে না সংস্কৃতিমনা বাঙালি মন, এ বার সেটা মোদি-শাহরাও বুঝে গেছেন। যেহেতু এই সিরিজের ব্যক্তিগত আক্রমণ বিজেপি শুরু করেনি, তাই তৃণমূলও এবার ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে নামেনি।কারণ একদিক থেকে নিম্নস্তরের লোক আক্রান্ত হলেও বাংলার ভোটাররা মেনে নেবে না। তাই বাধ্যবাধকতা ছিল উভয় পক্ষের। তবে বোধহয় শুধু বাধ্যবাধকতা নয়, বাঙালির রাজনীতির উন্নতিই রাজনীতিবিদদের সুমতি। নইলে একুশেও একই বাধ্যবাধকতা ছিল। তাতে রাজি হননি দেশের শীর্ষ নেতারা। সে তুলনায় এবার উন্নতি হয়েছে। শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলে আজ লিখতেন, রাম মারা গেছেন…